তাদের আক্ষেপের বিশ্বকাপ

সময়ের সেরা ফুটবলার কে? কেউ বলবেন লিওনেল মেসির কথা, কেউ বা বলবেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর কথা। ক্লাব ফুটবলে এই দু’জনের ক্যারিয়ারে অর্জনের কোনো শেষ নেই। এবার যেন অপ্রাপ্তিতেও দু’জনের ভাগ্যরেখা এসে একই বিন্দুতে মিললো। দু’জনের দল মানে আর্জেন্টিনা ও পর্তুগাল যে বাদ পড়েছে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্ব থেকে। মেসির বয়স এখন ৩১, রোনালদোর বয়স ৩৩। তাই মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আগামী বিশ্বকাপে তারা থাকছেন না। ফলে বিশ্বকাপটা এই দুই মহাতারকার কাছে আক্ষেপের অপর নাম হয়েই থাকবে। বিশ্বকাপ মানেই বিশ্বতারকাদের মেলে ধরার মঞ্চ। কিন্তু এই মেসি, রোনালদোর মত অনেকেই আছেন, যারা নিজেদের সময়ে সেরা ফুটবলার হলেও কখনোই বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। তাদের কথা জানাচ্ছেন কাওসার মুজিব অপূর্ব

আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (আর্জেন্টিনা-স্পেন-কলম্বিয়া)

আলফ্রেডো ডি স্টেফানো নিঃসন্দেহে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা। পেলে কিংবা ইউসেবিওরা বলে গেছেন স্টেফানোর মত পরিপূর্ণ ফুটবলার তারা আগে কখনো দেখেননি। কলম্বিয়ান ক্লাব মিলিওনারিসে নাম করার পর তিনি ১৯৫৩ সালে আসেন রিয়াল মাদ্রিদে। স্টেফানো আর রিয়াল মাদ্রিদ একে অন্যের সমার্থক। রিয়ালকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যান স্টেফানো। ৫০-এর দশকে তিনি এই ক্লাবের হয়ে জয় করেন পাঁচটি ইউরোপিয়ান কাপের শিরোপা। তবে বিশ্বকাপ মানেই স্টেফানোর জন্য আক্ষেপ। আর্জেন্টিনার নাগরিক ছিলেন। সেই সূত্রে, আর্জেন্টিনার হয়ে ১৯৫০ ও ১৯৫৪—এই দুটি বিশ্বকাপ খেলতে পারতেন। কিন্তু এই দুটো খেলতেই অস্বীকৃতি জানায় আর্জেন্টিনা। এরপর স্টেফানো খেলেন কলম্বিয়ার হয়ে। সেখান থেকে স্পেন চলে আসেন। স্পেন ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপের মূল পর্বে সুযোগ পায়নি। তবে পেয়েছিল ১৯৬২ সালে। যদিও টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই এক ইনজুরির কারণে আর বিশ্বকাপ খেলা হয়নি স্টেফানোর। হতাশা থেকে তিনি অবসর নিয়ে ফেলেন।

জর্জ বেস্ট (নর্দান আয়ারল্যান্ড)

তিনি রীতিমত সিনেমার এক চরিত্র ছিলেন। মাঠে যেমন খেলতেন দুর্দান্ত, তেমনি মাঠের বাইরের জীবন ছিল এলোমেলো। নারী, মদ, জুয়া— কোনো কিছুই বাদ ছিল না। ফুটবল ইতিহাসের প্রথমদিককার ‘ব্যাড বয়’দের একজন তিনি। তবে, ভক্তদের কাছে তিনি ছিলেন পছন্দের পাত্র। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সেরা খেলোয়াড় তো বটেই, জর্জ বেস্টকে অনেকে বিশ্ব ফুটবলেরও অন্যতম সেরা মানেন অনেকে। স্বয়ং পেলে তাকে সর্বকালের সেরা মানেন। তবে এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ক্যারিয়ারে কখনো বিশ্বকাপ খেলারই সুযোগ পাননি। কারণ যখন ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন তখন, মানে ১৯৬৬, ১৯৭০ কিংবা ১৯৭৪ সালেও বিশ্বকাপের জন্য বাছাইপর্বের বাঁধাই পেরোতে পারেনি আইরিশরা।

লেভ ইয়াশিন (সোভিয়েত ইউনিয়ন)

সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে?—এই প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক চললেও সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক যে লেভ ইয়াশিন, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। অসাধারণ রিফ্লেক্স ও কালো জার্সি পরার সুবাদে তার ডাকনাম ছিল ‘দ্য ব্ল্যাক স্পাইডার’। গোলরক্ষকরা যে আধুনিক ফুটবলে সুইপার ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতে পারে সেটা প্রথম দেখা গিয়েছিল এই ইয়াশিনের সৌজন্যে। টানা ১৩ বছর তিনি সোভিয়েত গোলপোস্টের নিচেছিলেন দলের এক নম্বর পছন্দ। ক্লাব ফুটবলে তিনি ডায়নামো মস্কোতে ২০টি বর্ণাঢ্য বছর কাটিয়েছেন। তবে আক্ষেপের ব্যাপার হলো বিশ্বকাপে কখনোই তার দল সেমিফাইনালের ওপরে উঠতে পারেনি।

মিশেল প্লাতিনি (ফ্রান্স)

ফরাসী ফুটবলকে প্রথম স্বর্ণালি দিনে নিয়ে যান মিশেল প্লাতিনি। তিনি ফ্রান্সকে ১৯৮৪ সালের ইউরো এনে দেন, নয় গোল করে তিনি ছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলাদাতা। একটা মাত্র আসর খেলার পর আজো তার ইউরোর সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড টিকে আছে। প্লাতিনি দল নিয়ে ১৯৮২ ও ১৯৮৬— দু’টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেন। প্লাতিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলদাতাদের একজন ছিলেন। ৫৮০ টি ম্যাচে ক্লাব পর্যায়ে তার গোলসংখ্য ৩১২টি। একজন স্ট্রাইকার হিসেবে এই পরিসংখ্যান খুবই ঈর্ষণীয়। টানা ২০ বছর তিনি ছিলেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ গোলদাতা ফুটবলার।

রাউল (স্পেন)

রাউল স্পেনের হয়ে খেলেছেন ১০ বছর। তবে, কখনোই জাতীয় দলের হয়ে বড় কোনো সাফল্য পাননি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে স্পেন প্রথম পর্ব থেকে ছিটকে যায়, ২০০২ সালে খেলে কোয়ার্টার ফাইনাল, আর ২০০৬ সালে দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়ে বাদ পড়ে। তবে বিশ্বকাপ জয়ের সকল গুণাবলিই ছিল রাউলের মধ্যে। তিনি রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে খেলা সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার। মাদ্রিদিস্তাদের হয়ে তার অভিষেক হয় ১৯৯৪ সালে। ক্লাবটিতে তিনি ছিলেন টানা ১৬ বছর। ৭০০টির ওপর ম্যাচ খেলেছেন রিয়ালে, করেছেন ৩০০’র বেশি গোল। কেবল উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই তার গোল সংখ্যা ৭১ টি!

ফেরেঙ্ক পুসকাস (হাঙ্গেরি-স্পেন)

ফেরেঙ্ক পুসকাস ছিলে জাদুকরী হাঙ্গেরি দলের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বেই ১৯৫৪ সালে বিশ্বকাপের ফাইনালে গিয়েছিল হাঙ্গেরি। হেরে যায় পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে। ম্যাচটায় হাঙ্গেরি ৩-২ গোলে হারে। যদিও গ্রুপ পর্বে এই হাঙ্গেরির বিপক্ষেই ৮-৩ গোলে বিধ্বস্ত হয় পশ্চিম জার্মানি। ফাইনালের আগে টানা ৩১টি ম্যাচে অপরাজিত ছিল হাঙ্গেরি। কিন্তু সব হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে যায় ফাইনালে। পুসকাস সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করেছিলেন। যদিও তাতে উপকার হয়নি হাঙ্গেরির। ১৯৬২ বিশ্বকাপটা তিনি খেলেন স্পেনের হয়ে। দল নিয়ে এবার গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়তে হয় তাকে। যদিও সেই বিশ্বকাপের আগেই সেরা সময়টা পেছনে ফেলে এসেছিলেন পুসকাস। পুসকাস হলেন ফুটবল ইতিহাসে সর্বকালের সেরা গোল মেশিনদের একজন। হাঙ্গেরির হয়ে ৮৫ টি ম্যাচে ৮৪টি গোল তার। যদিও কোনোকালেই আউট-অ্যান্ড-আউট স্ট্রাইকার ছিলেন না তিনি। আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর সাথে রিয়াল মাদ্রিদে তার জুটি ইউরোপিয়ান সার্কিটে রীতিমত প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিতো।

ইয়োহান ক্রুইফ (নেদারল্যান্ডস)

বলা হয়, পেলে ও ম্যারাডোনার পর ইয়োহান ক্রুইফই সর্বকালের সেরা ফুটবলার। তিনি টোটাল ফুটবলের অন্যতম প্রবাদপুরুষ। আয়াক্স আমস্টারডাম ও বার্সেলোনার হয়ে তিনি অসংখ্য শিরোপা জিতেছেন। খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে কোচ হিসেবেও ছিলেন সফল। তবে আক্ষেপ একটাই— জিততে পারেননি বিশ্বকাপ। ১৯৭৪ সালে এই ক্রুইফের নেতৃত্বেই ফাইনালে চলে যায় নেদারল্যান্ডস। ‘টোটাল ফুটবল’-এর জনকরা বিশ্বকাপের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে হেরে যায় ২-১ গোলে। সেই ম্যাচটা বিশ্ব ফুটবলের জন্যই বড় একটা আক্ষেপ। কারণ নিজেদের সময়ের তো বটেই ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দল ছিল ’৭৪-এর নেদারল্যান্ডস। ১৯৭৮ সালেও ফাইনালে যায় নেদারল্যান্ডস। এবার ফাইনাল হারে স্বাগতিক আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। তবে খেলেননি ক্রুইফ। বিশ্বকাপের আগেই তিনি এক অজ্ঞাত কারণে অবসর নিয়ে ফেলেন। এক সাক্ষাত্কারে সম্প্রতি বলেছেন, পরিবারের ওপর অপহরণের হুমকি ছিল, তাই আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।

পাওলো মালদিনি (ইতালি)

১৯৮২ সালের পর বিশ্বকাপ জয়ের পর নিজেদের চতুর্থ ও সর্বশেষ বিশ্বকাপ ইতালি জিতেছিল ২০০৬ সালে। এই সময়ের মধ্যে পাওলো মালদিনির ক্যারিয়ার শুরু হয়ে শেষ হয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯৯০ সালে মালদিনির ইতালি সেমিফাইনাল হেরে তৃতীয় হয়ে বিশ্বকাপ শেষ করে। ১৯৯৪-এ ফাইনাল খেলে, কিন্তু হেরে যায় ব্রাজিলের বিপক্ষে। ১৯৯৮ সালে মালদিনিরা খেলেন কোয়ার্টার ফাইনাল আর ২০০২ সালে দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়ে শেষ হয় তাদের যাত্রা। বিশ্বকাপটা মালদিনির জন্য আক্ষেপ হলেও ক্লাব ফুটবলে তিনি ছিলেন বড় নাম। তিনি হলেন এসি মিলানের কিংবদন্তি। ইতালিয়ান এই ক্লাবটিতে ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৯ অবধি খেলেছেন। এর মধ্যে ১০ বছরেরও বেশি ছিলেন তাদের অধিনায়ক। যৌথভাবে এই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার সবচেয়ে বেশি ইউরোপিয়ান কাপ বা অধুনা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল খেলার রেকর্ডের মালিক। আট ফাইনাল খেলে জিতেছেন পাঁচটিতেই। ফুটবল হিসেবে তার চেয়ে বড়মাপের ডিফেন্ডার আর নেই বললেই চলে।

জিকো (ব্রাজিল)

১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৬ — মোট তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন জিকো। কিন্তু কোনোবারই সেমিফাইনালের বাঁধা পেরোতে পারেননি। ১৯৮২ সালে ব্রাজিল দলটাকে বলা হয়েছিল, বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল। তবে, সেলেসাওরা সেবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালির বিপক্ষে সেমিফাইনালে হেরে বাদ পড়ে। মধ্যমাঠের খেলোয়াড় আর্থার আনটিউন্স কোইমব্রা, ওরফে ‘জিকো’কে বলা হতো ‘সাদা পেলে’। সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের তালিকায় থাকা জিকোকে বলা হতো ’৭০-’৮০’র দশকে বিশ্বের সেরা ফুটবলার। যদিও সেই সময়ে বিশ্বে পাওলো রসি, ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা কেনি ড্যাগলিশের মত খেলোয়াড়রা ছিলেন।

ইউসেবিও (পর্তুগাল)

পর্তুগাল ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ খেলার সুযোগই পায়নি। ফলে ইউসেবিও ও তার দল পর্তুগাল খেলতে পেরেছিল মাত্র একটা বিশ্বকাপ। ১৯৬৬ সালে সেবার ইউসেবিও দল নিয়ে সেমিফাইনাল চলে গিয়েছিলেন, তবে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় পর্তুগালকে। ইউসেবিও হলেন পর্তুগালের ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়াড়দের একজন। তারই দেখানো রাস্তায় পরবর্তীতে হেঁটেছে লুইস ফিগো কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরা। ইউসেবিও পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকায় খেলে প্রথম আলোচনায় আসেন। এরপর ১৯৬৬ বিশ্বকাপে গিয়ে করেন নয় গোল। তার জন্ম মোজাম্বিকে। মনে করা হয়, আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া সেরা ফুটবলার তিনি। তিনি আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক ছিলেন। পর্তুগালে তার ডাকনাম ছিল ‘ও রেই’; এর অর্থ হলো রাজা!